শ্বাসমূলিয় বনের মাঝে শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে রয়েছে লবন জলের ছোট বড় নদী এবং খাল। আর এই নদী খালই বাংলাদেশের দক্ষিণা একাধিক জেলার মানুষের জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে শত শত বছর ধরে। ডাঙায় বাঘ জলে কুমির এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করে কোটি মানুষের আমিষের চাহিদা মিটিয়ে চলেছে একদল মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত মানুষ। অপর দিকে একদল মানুষ ঠান্ডা ঘরে বসে মোটা বইয়ের জ্ঞান আহরণ করছেন এবং সুন্দরবন রক্ষার ভিন্ন ভিন্ন পন্থা বাতলে দিচ্ছেন৷ আর তার প্রায় সব গুলো উপয়াই মাথা ব্যাথায় মাথা কেটে ফেলার মতো। রোদ বৃষ্টি এবং লবন জলে ঝলসানো চামড়ার মানুষ গুলো সদ্য বিগত ৩ মাস সুন্দরবনে যে কোন ধরনের সম্পদ আহরণের নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে জীবিকায় ফিরেছেন। কি করেছেন এই ৩ মাস উপকূলের এই মানুষ গুলো যাদের সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হয়েই জীবিকা। এই জনপদে কি এই ৩ মাসের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে? তারা কি সত্যি বিকল্প আয়ে এই ৩ মাসে দু বেলা খাবার জুটিয়েছেন ? আমার জানামতে না৷ সেই সুযোগ নেই। এই জনপদে এমন কোন আয়ের উৎস নেই যে এই হাজার হাজার বনজীবি এবং তাদের পরিবারের ৩ মাসের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে। আবার যাদের চালের দাম হঠাৎ একটু বাড়লে ডাল কেনার টাকার কম পড়ে তাদের কাছে সঞ্চয়ের টাকায় চলেছে সংসার এমনটা ভাবা বোকামী ছাড়া কিছু নয়৷ এর উত্তর সহজ। মানুষগুলোর বড় অংশ এই ৩ মাসও সুন্দরবনকেই বেছে নিয়েছে আয়ের উৎস হিসেবে৷ পার্থক্য শুধু বন্ধের ৩ মাস অবৈধ ভাবে সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া ধরেছে এবং এদের একটি অংশ দ্রুত কাজ সারতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরেছে যা সুন্দরবনকে করেছে দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতবিক্ষত। এ কথার সত্যতা মেলে বিগত ৩ মাস বনবিভাগ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা আটোক জেলেদের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে । বন বিভাগ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা আটক জেলেদের খবর দেখে অনেকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন এই ভেবে যে অপরাধ দমন হচ্ছে ।
কিন্তু গল্পটা ভিন্ন৷ আসুন আটোক এই তথাকথিত ভয়ঙ্কর অপরাধীদের পরিবারের খবর নিই ৷ এদের বাড়ি বলতে ঝুপড়ি ঘর। কর্তার জেলে যাওয়ার খাবারের চিন্তা ছাপিয়ে এদের পেটের ক্ষুধার জ্বালাটা বুঝতে বেশী কিছু করা লাগবে না৷ এই ঝুপড়ি ঘরে চুলার উপরের পাতিলের দিকে তাকালেই বুঝতে পাবেন৷ হয়ত বাড়ীর কিশোরকে সন্ধার পর প্রস্তুতি নিতে দেখবেন রাতের অন্ধকারে আবারও জঙ্গলের পথে মাছ কাকড়ার আশায়৷ এখন বরং ডবল মাছ চাই৷ ভাতের পাশাপাশি বাবার মামলার খরচ যোগাতে হবে৷ তাই বিষের পরিমান বাড়িয়ে নিয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব বেশী মাছ চাই।
পৃথিবীটা মানুষের জন্য এবং সৃষ্টির সকল জীবনের জন্য । নিশ্চই সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষ সুন্দরবনের বন্য জীবনের অংশ৷ হাজার বছরের পুরাতন সুন্দরবনেও মানুষ জীবিকা করেছে। আমার মনে হয় সুন্দরবনের কোন বিশ্রাম প্রয়োজন নেই৷ সুন্দরবনে একমাত্র সুস্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ম মেনে সম্পদ আহরণ করলে তা যদি সারা বছরও হয় তবু অকৃপণ ভাবে সম্পদ বিতরণ করে যাবে৷ এই মানুষ্য জীবনকে অভুক্ত রেখে কখনো সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে না৷ বিগত বছরের তুলোনায় বর্তমান বন বিভাগ অনেক বেশী আন্তরিক বন্য আপরাধ নির্মুলে৷ কিন্তু ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটারের সুন্দরবনে এতো অল্প বন কর্মী এবং তাদের বাহনের সীমাবদ্ধতায় কতোটা সম্ভব বন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সেইটাও বিবেচ্য বিষয়।
সুন্দরবনে সরাসরি প্রায় ১ লক্ষ জেলে মাছ ধরার সাথে জড়িত এবং কয়েক হাজার মৌয়ালি ,ব্যাবসায়ী সহ প্রায় ১০ লাখ মানুষ সুন্দরবনের উপর সরাসরি নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং এদের দ্বারা প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিকটন কাঁচা মাছ, হাজার কোটি টাকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন শুটকি, ২ হাজার মেট্রিকটন কাঁকড়া এবং ১৪০০ কুইন্টাল মধু উৎপাদন হয়৷ (তথ্য সূত্র: বনবিভাগ এবং জাতীয় পত্রিকা এবং শুটকি যোগ্য মাছ সুন্দরবন সংলগ্ন সাগর থেকে আহরণ হয় যা সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। )
সুন্দরবনে উৎপাদিত মাছ কোটি মানুষের আমিষের চাহিদা মিটিয়ে আসছে যুগযুগ ধরে৷ সেই সাথে দক্ষিণ বাংলার সকল মানুষ কোননা কোন ভাবে সুন্দরবন থেকে আহরিত মাছ, কাঁকাড়া, মধু সহ সকল বৈধ সম্পদ আহরণ থেকে সুফল পেয়ে আসছে।
এসবের পাশাপাশি বর্তমানে সুন্দরবনে সুন্দর ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প৷ পর্যটনের বিকাশের ফলে প্রতি বছর লক্ষ পর্যটক ৩/৪ দিনের জন্য শিপে করে সুন্দরবন ভ্রমণ করে থাকে৷ সাথে আরো বেশী পর্যটক আসছে সুন্দরবনের লোকালয়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা পর্যটন কেন্দ্রে দিনে দিনে ভ্রমণের জন্য। এই পর্যটকদের দ্বারা সরাসরি লাভবান হচ্ছে পরিবহণ খাত, আবাসন খাত এবং স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন নিত্য পন্য বিক্রেতারা। পর্যটন বাহি এইসব শীপে কাজ করছে হাজারো মানুষ যারা অধিকাংশই এই জনপদের স্থানীয় বাসিন্দা। দক্ষিণ বাংলার এই জনপদের অর্থনীতিতে সুন্দরবন বিশাল অবদান রেখে চলেছে যুগযুগ ধরে।
সুন্দরবনে সমস্ত দেখভালের মূল দ্বায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ বন বিভাগ৷ বন বিভাগের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণের এবং পর্যটন পরিচালনার ক্ষেত্রে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমানে সুন্দরবনের প্রায় অর্ধেক অঞ্চকে অভয়ারণ্যে ঘোষণা করেছে৷ নীতিমালা অনুযায়ী অভয়ারণ্যে মাছ ধরা সহ কোন ধরণেরই সম্পদ আহরণের সুযোগ নেই একমাত্র পর্যটকেরা এসব অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পারবেন নিয়ম মেনে।
সুন্দরবনে পর্যটন বিকাশে লাভ বা ক্ষতির হিসাব তুলে ধরার চেষ্টা করবো পরবর্তী পর্বে।
মো: তানজির হোসেন (রুবেল)
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সুন্দরবন।