পেশায় আমি ট্যুর অপারেটর হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের প্রায় সব টুরিষ্ট স্পটে ভ্রমণের ভাগ্য আমার হয়েছে। আমার এই গল্প ওরকম কোনো ভ্রমণ স্পটের নয়। গল্পটি গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের যার নাম শশিকর। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় এক হিন্দু অধ্যসিত এলাকা এবং ভ্রমণটি সেই গ্রামেরই সম্ভ্রান্ত এক বাড়িতে। আমরা যারা গিয়েছি এবং যে বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছি সবাই আমার সঙে পূর্বেই একাধিক টুরিষ্ট স্পটে ভ্রমণ করেছে এবং সেই টিমের একজনের ব্যাক্তিগত দাওয়াতেই এই ভ্রমণ। যে বাড়িতে ছিলাম তার চার পাশে জল, বাড়িতে যেতে হয় নৌকা বা লম্বা বাশের সাঁকো পার হয়ে। বাড়ির চার পাশের পরিবেশ অদ্ভুত সুন্দর। বাড়ির পিছনের বিলের জলে শাপলা ফুল চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। চার পাশে জল শাপলা এবং একটু দূরে দূরে দ্বীপ বাড়ী। প্রথম দিনেই বাড়ির বড় দাদার সাথে গেলাম পূর্বে ফেলে রাখা “চাই” তুলে মাছ ধরতে( চাই হলো বাঁশের তৈরী এক ধরণের মাছ ধরার ফাঁদ)। চাইতে আটকা পড়া কৈ, টাকি আর পুটি নিয়ে বাড়িতে দিয়েই বিলের মধ্যে নৌকায় করে “ভুত পুকুরে ” ঝাপা ঝাপি। ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে ভুড়ি ভোজ কয়েক প্রকার পিঠা দিয়ে। কোনো বিশ্রাম নয়, সুন্দরের মাঝে এনার্জির অভাব হয় না তাই গেলাম পাশের গ্রামের পদ্ম বিলে। আমাদের টিমে যোগ হলো সাড়ে তিন বছরের স্মার্ট আর্য সরকার এবং আহ্লাদী চন্দ্রাবতী। কয়েকটি বাড়ির উঠান পেরিয়ে পদ্ম বিলের দেখা পেলাম যখন ডিঙ্গি নৌকায় বিলের মধ্যে তখন সন্ধার আগমুহূর্ত। কনে দেখা আলোতে পদ্ম বিল হয়েছে অসাধারণ রকমের সুন্দর। পদ্ম পাতার উপর সোনা ব্যাঙের লাফা লাফি, আর ব্যাঙের পিছনে সাপের দৌড়। বিলের মধ্যেই সূর্য ডুবি হলো। অন্ধকারে মোবাইলের আলো জালিয়ে মেঠো পথ পার হয়ে ভ্যানে করে আসলাম পীড়ার বাড়ি বাজারে। বাজারে এসে মিষ্টির দোকানে হামলে পড়লাম গরম রসগোল্লার উপর। (ইচ্ছে ছিলো আমার কাছে পাওনা মিষ্টি আমি বিল দিয়ে শোধ করবো। কিন্তু ব্যর্থ হলাম স্থানীয় মাস্তান, যার মেহমান হিসাবে আমরা আছি তার কাছে।) এর পর বাড়ির পথ ধরলাম। বাড়ি ফিরেই উঠনে বসে আড্ডা চলছে এবং আড্ডার মাঝেই রাতের খাবারের ডাক পড়লো। বিশাল আয়োজন। শাপলার বড়া,কুমড়ো ফুলের বড়া,শোলা ফুলের বড়া,ইলিশ মাছ ভাজি,খলিশা মাছ ভাজি, হাসের মাংস, ডাল এবং দিদির হাতে বেড়ে দেওয়া খাবারে আমার মোটা হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু। খাওয়া শেষে লক্ষ করলাম আকাশে ভাঙা চাঁদ আর তখন আমরা নৌকায় শাপলা বিলের মাঝে, চুপচাপ জ্যোৎস্না স্নান আর বিচিত্র সব জলজ প্রাণীর ডাক শুনে বাড়িতে এসে ঘুম। খুব সকালে সবাই রেডি, গন্তব্য লাল শাপলার বিল,বরিশালের সাতলা গ্রামে। সাতলা গ্রামে লাল শাপলার বিলে প্রকৃতি যে রুপ দেখলাম, মনের অজান্তে বলি “ধন্য আমি জন্মেছি এই দেশে”। লাল শাপলার বিল দেখে এবং সুন্দর কিছু ছবি তুলে দুপুরের আগে বাড়ি ফিরলাম। দুপুরের খাবারে আবারো হরেক রকমের সুস্বাদু তরকারী আর দিদির বেড়ে দেওয়া খাবার, দিদি যেনো শপথ করেছে আমাদের মোটা বানিয়েই ছাড়বেন। বিকেলে গেলাম পিছনের বিল পার হয়ে মেঠো পথে ছবি তুলতে। ছবির মতোই সুন্দর, সাজানো। সূর্যাস্তের পর বাড়ি ফিরে ছোট কাকার বাড়ির ছাদে আড্ডা। ছোট কাকা লেখক মানুষ, তাই তার বাড়ি এবং ছাদে শিল্পের ছোঁয়া ভালো মতোই পেলাম। রাতের খাবারের ডাক পড়া পর্যন্ত ছাদে আড্ডা চললো এবং তার পর ঘুমের পালা। সকালে নাস্তার পর বের হলাম শাপলা তুলতে। শাপলা উঠানো আর ছবি তলা চললো এক’ই সাথে। ফিরে এসে এক দল চললো কাঁদা-জলের মধ্যে কাবাডি( টেক টেক) খেলতে, আর আমি ছিপ দিয়ে মাছ ধরার ব্যর্থ চেষ্টায়। এর পর গোছ-গাছ করা, দুপুরের খাবার খাওয়া এবং ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রকৃতির মায়া ছেড়ে পেটের টানে জঞ্জাল শহরের পথে যাত্রা।
ভ্রমণের সময় : ৩০ শে আগষ্ট ২০১৮ থেকে ৩ দিন।
©Tanjir H Rubel